মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:৩৭ অপরাহ্ন

মানবসেবার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক দম্পত্তি

মানবসেবার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক দম্পত্তি

বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন চাঁদপুরের এক চিকিৎসক দম্পতি। তারা হলেন, চাঁদপুরের আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও এবং করোনাভাইরাস বিষয়ে ফোকালপার্সন ডাঃ এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেল ও চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন। দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সহকর্মীদের অনেকেই যখন আত্মরক্ষায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন তখন মানবসেবার ব্রত নিয়ে করোনাবিরোধী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছেন এই চিকিৎসক দম্পতি। একমাত্র সন্তানকে দাদা-দাদীর কাছে রেখে করোনা চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালে নিরলস পরিশ্রম ও সাধারণ মানুষের পাশে থেকে আন্তরিকতার সাথে সেবা দেয়ায় ’করোনা জেনারেল’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন । বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তাকে এই উপাধি দেয়া হয়। আর চাঁদপুরের আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে করোনাভাইরাস বিষয়ক ‘ফোকাল পারসন’ ও মেডিক্যাল টিমের প্রধান হিসেবে মনোনীত করেছে।

চলমান করোনাযুদ্ধে নিঃসন্দেহে চাঁদপুরে চিকিৎসকদের মধ্যে শীর্ষযোদ্ধা এই দম্পতি। সেবা নিতে আসা মানুষ, শনাক্তকৃত রোগী, স্বজন, সহকর্মী ও স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তারাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেশে করোনা সংক্রমের শুরুতেই আইইডিসিআর’র করোনা বিষয়ক প্রশিক্ষণে জেলা থেকে শুধুমাত্র এই দু’জন চিকিৎসক অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরো কয়েক দফা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এই চিকিৎসক দম্পত্তি। চাঁদপুর জেলায় করোনার রোগী বাছাই, নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা বিষয়ে যেসব চিকিৎসকের নাম সর্বোচ্চ ধাপে তাদের মধ্যেও শীর্ষে রুবেল-পলিন দম্পতি। এই চিকিৎসক যুগলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ফসল হিসেবে চাঁদপুর জেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলা ও সদর হাসপাতালে।

হাসপাতালের নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র দেয়া, শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতাল অথবা বাসায় (আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন) চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান ও চিকিৎসাপত্র দেয়া, আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রোগীদের বাড়তি নজর রাখা, মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা – একাধারে এসব কাজ করতে হয় ডাঃ রুবেলকে। এর পাশাপাশি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনসহ আরো অনেকের সাথে কথা বলতে হয়, তথ্য দিতে হয়। পরম ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে হাসিমুখে এতসব সামাল দিচ্ছেন তিনি।

ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, আসলে চাকরি বলেই নয়, মানবিক কারণে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছি। কাজের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো লোকজন তাদের সব উপসর্গ বলতে চায় না। এতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে। টানা ডিউটির পর বাসায় গেলে জরুরি প্রয়োজনে আবারো আসতে হয়। সেটা দিনে হোক আর গভীর রাতেই হোক। সবচেয়ে বেশি মিস করি আমাদের একমাত্র সন্তানকে। ভাগ্যিস, আমার বাবা-মা বাসায় আছেন। তাই তাদের কাছে সন্তান রেখে আমরা দু’জন মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানবসেবার ব্রত নিয়েই তো ডাক্তার হয়েছি। মাঝে মধ্যে ক্লান্তিও আসে কিন্তু পিছু হটলে তো হবে না। নিজেদের করোনাযুদ্ধের প্রহরী মনে করে আবার এগিয়ে যাই। এখান থেকে পিছু হটার সুযোগ তো নেই!

সাজেদা বেগম পলিন বলেন, চিকিৎসা সেবাদানের ক্ষেত্রে আমার কোনো হাসপাতাল নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি টিম পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, সন্দেহভাজন, আক্রান্ত, মৃতদের বাসা লকডাউন করার কাজ প্রতিদিনই করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কোভিড-১৯’ নামের এক ফেইসবুক পেইজ থেকে লাইভে প্রতিদিন এ রোগ বিষয়ক তথ্য, পরামর্শ, চিকিৎসা ও সতর্কতা তুলে ধরছি। আসলে কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, কখন দিন যায়, রাত পার হয়- তা সব সময় টের পাই না।

তিনি আরো বলেন, চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের পাশাপাশি এখন ১৫ ওয়ার্ডের চাঁদপুর শহরটিও দেখতে হয়। কষ্ট তো হয়, খারাপও লাগে। ছেলেটাকে অনেক মিস করি। এখন আর আগের মতো সময় দেয়া হয় না তাকে। বৃদ্ধ শশুর-শ্বাশুড়ি বাসায়, আমাদের কারণে তারা আক্রান্ত হন কিনা সেই ভয়েও থাকি। বাসায় তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি- এটা যে কত কষ্টের তা বুঝানো যাবে না। মানুষের উপকারে আসতে পারাটা অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আশায় বুক বাঁধি- এ দুর্যোগ তো স্থায়ী হবে না। করোনা তো একদিন পরাস্ত হবেই। আমরা করবো জয়, একদিন! আমরা চিকিৎসকরা মানবসেবার যে ব্রত নিয়ে এ পেশায় যোগদান করেছি, সেটি যদি কর্মক্ষেত্রে এসে বাস্তবে রূপ দিতে পারি, তখন নিজের কাছে ভালো লাগে। দেশের জনগণের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা, তা পূরণ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ আহসান উল্যাহ বলেন, এই চিকিৎসক দম্পত্তি মানবতার সেবকদ্বয় নিরলসভাবে সেবা দিয়ে চলেছে। তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, ধৈর্য্য ও সাহসিকতা অতুলনীয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে অথবা এ সংক্রান্ত যে কোনো বিষয় সংবাদ জানার জন্য সংবাদিকরা তাদের সাথে যখনই যোগাযোগ কিংবা মোবাইল করতো, কোন রকম বিরক্ত কিংবা অসন্তুষ্ট না হয়ে ব্যস্ততার মাঝেও করোনা বিষয়ে তথ্য দিয়ে যেতো। রোগী বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে তাদের ব্যস্ততা, কাজের পরিধি, দায়িত্ব ও কর্তব্য। অবিরাম পরিশ্রমের ফলে শারীরিকভাবে কাতর হলেও মনের জোরটা এখনো ধরে রেখেছেন তারা।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এ চিকিৎসক দম্পতি শহরের আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা, নমুনা সংগ্রহ ও সচেতনতায় শুরু থেকে সক্রিয় রয়েছেন। সন্তানকে দূরে ঠেলে মানবকল্যাণে দিন-রাত খাটুনির চিত্র এ জেলায় দ্বিতীয়টি না থাকায় এ দম্পতি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ডা.সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে করোনাভাইরাস বিষয়ক ‘ফোকাল পারসন’ ও মেডিক্যাল টিমের প্রধান হিসেবে মনোনীত করে কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যে শতভাগ সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল ডা: রুবেল তার কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন। এছাড়াও ডা. সুজাউদ্দৌলার পাশাপশি করোনার সময়ে ডা. সাজেদা বেগম পলিন রোগীদের সেবায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণেই স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ‘করোনা জেনারেল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। চট্রগ্রাম বিভাগের ১৪ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে করোনাযুদ্ধের জেনারেল উপাধি দেয়া হয়। এদের মধ্যে ডা. সাজেদা বেগম পলিন অন্যতম।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877